নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় দান করলেন ঢাবি অধ্যাপক
নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ৪০ লাখ টাকা দান করলেন ঢাবি অধ্যাপক। অর্থাভাবে ১৪ বছর ধরে একতলায়ই আটকে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের ভবন নির্মাণের কাজ। ক্লাসরুম সংকট, অপরিসর গবেষণাগার, শিক্ষকদের ঠিকমতো জায়গা হয় না। এমন অবস্থায় প্রিয় বিভাগের ভবন নির্মাণের জন্য এগিয়ে এলেন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফি।
পঞ্চাশের দশকের বগুড়ার শান্তাহার। এলাকার বেশির ভাগই দরিদ্র। দিন এনে দিন খায় অবস্থা। সে তুলনায় ব্যবসায়ী আবদুল লতিফের অবস্থা সচ্ছল। আট ছেলেমেয়ের সংসার হলেও ভালোভাবেই দিন কেটে যায়। একদিন কী হলো, আবদুল লতিফ ১০০টা করে প্লেট, গ্লাস, ডেকচি, চামচ কিনে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরে সবার উৎসুক চোখের জবাবে বললেন, ‘প্লেট-ডেকচির অভাবে এলাকায় কেউ তো ভালোভাবে কোনো অনুষ্ঠানও করতে পারে না। এখন সবাই এগুলো ব্যবহার করতে পারবে।’ তারপর বিয়ে হোক, আকিকা হোক, এগুলো ব্যবহার করতে থাকল এলাকার লোকজন। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কখনো একটি পয়সাও নেননি আবদুল লতিফ। আবদুল লতিফের চতুর্থ সন্তান মোহাম্মদ শফির তখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স। কিন্তু এ ঘটনা ভীষণভাবে দাগ কাটে তাঁর মনে। বড় হয়ে ঠিক করেন, যতটা পারেন বাবার মতোই সাহায্য করে যাবেন মানুষকে।
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, বগুড়ার শান্তাহারে জমিজমাও আছে। ফলে শিক্ষকতা শুরুর পর অধ্যাপক শফিকে শুধু বেতনের টাকায় নির্ভর করতে হয়নি। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সময় গিয়েছেন গবেষণা করতে। সেখান থেকেও আয় হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে একটা বাড়ি ছিল। ১৯৯৮ সালে সেটা বিক্রি করে ফ্ল্যাট কেনেন এলিফ্যান্ট রোডে। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই বসবাস। দুই ছেলের একজন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, আরেকজন কানাডায়। একমাত্র মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। ‘এখন আমার কোনো পিছুটান নেই, ছেলেমেয়েরাও যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। অধ্যাপক শফি বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, নিজের স্বপ্নপূরণের এই-ই সময়।’ আর সে স্বপ্নপূরণের উপলক্ষ পেয়ে গেলেন নিজের বিভাগেই।
১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের যাত্রা শুরু হলো। বিভাগের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। প্রাণিবিদ্যা আর অণুজীববিজ্ঞানের ক্লাসরুমে জোড়াতালি দিয়ে চলে ক্লাস। ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিল নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য। সে টাকায় পাঁচতলার ভিতসহ একতলা পর্যন্ত হলো। তখন থেকেই সেটা ক্লাসরুম-কাম-গবেষণাগার। কথা ছিল, দ্রুতই পাঁচতলা ভবন নির্মাণ হবে। কিন্তু গত ১৪ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পুরো ঘটনায় ভীষণ মর্মাহত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফি। ঠিক করলেন, সমস্যার সমাধানে ব্যয় করবেন নিজের সারা জীবনের সঞ্চয়। নিজের বেতন থেকে জমানো ৪০ লাখ টাকা তুলে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে। এখন সে টাকা থেকেই তৈরি হবে মৎস্যবিজ্ঞান ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা। তিনি আরও বলেন, ‘বিভাগের জন্ম থেকেই সঙ্গে আছি। একতলা ভবনে গাদাগাদি করে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করে। গবেষণাগারে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, ঠিকভাবে শিক্ষকরাও বসতে পারেন না। প্রতিদিন এ দৃশ্য দেখতে আমার খুবই খারাপ লাগত’ বলতে বলতে অধ্যাপক শফির চোখ ভিজে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এমন বিরল দৃষ্টান্তে অভিভূত উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও, ‘তাঁর এই অবদানের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। তাঁর উদ্যোগ বিভাগের ছাত্রছাত্রীসহ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করবে।’
শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদান তাঁর এই প্রথম নয়। ২০১০ সালে তিন লাখ টাকা দিয়ে গঠন করেছিলেন ‘আমেনা-লতিফ ট্রাস্ট ফান্ড’। যেখান থেকে প্রতিবছর বিভাগের তিন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। ২০১১ সালে গঠন করা ‘ড. মোহাম্মদ শফি ট্রাস্ট ফান্ড’ থেকে অনার্স ও মাস্টার্সের প্রথম স্থান অধিকারীদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০০১ সালে নিজের জন্মস্থান শান্তাহারের বিপি স্কুলে বাবার নামে চালু করেন ‘আবদুল লতিফ ছাত্র বৃত্তি কল্যাণ ফান্ড’। একই বছর কলসা আহসানউল্লাহ ইনস্টিটিউশনে মায়ের নামে চালু হয় ‘আমেনা খাতুন ছাত্রী বৃত্তি কল্যাণ ফান্ড’।
শিক্ষা সংক্রান্ত খবরাখবর নিয়মিত পেতে রেজিস্ট্রেশন করুন অথবা Log In করুন।
Account Benefit১৯৫৫ সালে এই বিপি হাই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন অধ্যাপক শফি। ভর্তি হন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৭ সালে আইএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) আবাসিক ছাত্র ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব স্বেচ্ছাসেবক বন্যাকবলিত অঞ্চলে গিয়ে কলেরার ইনজেকশন দিতেন, সে দলে তিনিও ছিলেন। নিজের ক্যাম্পাসজীবনের কথা নিয়ে বেশ নস্টালজিক তিনি। প্রবীণ এ অধ্যাপক বলেন, ‘তখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগে আসন ছিল ১০টি। সে বছর মাত্র সাতজন ভর্তি হয়েছিলাম। এর মধ্যে মেয়ে ছিল চারজন। একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অবাঙালি। বেশ কড়া। ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশা একদম পছন্দ করতেন না। ফলে ক্লাসে বই-খাতার ভেতরে চিঠি আদান-প্রদান করতাম। এমনকি গ্রীষ্মের ছুটিতেও পরস্পরের কাছে চিঠি লিখতাম। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালে আমরা কক্সবাজারে শিক্ষা সফরে যাই। কিন্তু মেয়েটি যায়নি। ফিরে এসে শুনি বুয়েটের এক শিক্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে।’
এই প্রেমের গল্পের শেষটা আরো বেদনার, অনেকটা সিনেমার মতোই। ‘তখন আমাদের রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস রাতে হতো। এক রাতে ক্লাস চলার সময় মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করল। ওর লেখা চিঠিগুলো ফেরত চাইল। আমি দিয়ে দিলাম। এরপর পুরো ক্লাসেই আর মন বসল না। অন্যমনস্কতার কারণে হঠাৎই টেস্টটিউবে ছোটখাটো বিস্ফোরণ হলো। কিছুটা আহত হলাম। বন্ধুরা ধরে মেডিক্যালে নিয়ে গেল।’
১৯৬১ সালে একদিন অধ্যাপক শফি হলে ফিরে দেখলেন, রুমে একজন অপরিচিত লোক বসা। শফিকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যক্ষ। আমার কলেজে বায়োলজির কোনো শিক্ষক নেই। আপনার তো পরীক্ষা শেষ। বিছানা বাঁধেন, আমার সঙ্গে চলেন।’ ওই কলেজে চাকরি করেছিলেন তিন মাসের মতো। মাস্টার্সের ফল বেরোনোর পর যোগ দেন যশোরের এমএম কলেজে। সেখানে ছয় মাস কাটিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রীয় বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে বছর পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় সব বৃত্তি স্থগিত করে দেয় সরকার। পরের বছর সুযোগ পেলেন স্কটল্যাল্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে গেল অধ্যাপক শফির জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হলেন মা, দুই ভাই ও তাদের স্ত্রীরা।
১৯৭২ সালে অধ্যাপক শফি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালের জুনে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হলো শিক্ষকতার জীবন। ১৯৭৮ সালে চার বছরের অবৈতনিক ছুটি নিয়ে যান ইরাকের বাগদাদে। ইরাকি মাছের ওপর গবেষণার জন্য বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য বিভাগে যোগ দেন প্রফেসর হিসেবে। ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে পুনরায় যোগ দেন নিজ বিভাগে। ১৯৯৮ সালে মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়। ‘একুয়াকালচার ও ফিশারিজ’ নামে নতুন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক মোহাম্মদ শফি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ বছরের চাকরি শেষে ২০০৫-এ অবসর গ্রহণ করেন অধ্যাপক শফি। অবসর গ্রহণ করলেও এখনো নিয়মিত নিজের কোর্সগুলো পড়াতেন তিনি। সপ্তাহে কমপক্ষে দুদিন বিভাগে আসেন। পরীক্ষা থাকলে তিন দিন। ‘ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া আমি থাকতে পারি না। যেদিন ক্লাস থাকে সেদিনটা খুব ভালো যায়’, বললেন প্রবীণ এ অধ্যাপক।
২০০৭ সালে অধ্যাপক শফিকে মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে সুপার নিউমেরারি প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি মাছ নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক শফি। নিজের গবেষণা নিয়ে লিখেছেন ছয়টি বই।
More detail about
Dhaka University
- মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ
- এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট কোর্স- ইংলিশ, চাইনিজ, আরবি, ফ্রেঞ্চ
- বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল-বিজ্ঞপ্তি
- বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর
- খুবির ৬ষ্ঠ সমাবর্তন ২২ ডিসেম্বর
- জবির সমাবর্তন ১১ জানুয়ারি
- জবিতে শূন্য আসনে ভর্তির সাক্ষাৎকার শুরু ২০ ডিসেম্বর
- রাবিতে আন্তর্জাতিক ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলন শুরু বৃহস্পতিবার
- অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু ১৩ জানুয়ারি; মাস্টার্স রিলিজ স্লিপ আবেদন শুরু ১৯ ডিসেম্বর
- ডিজিটাল মেলা-২০২০ উপলক্ষে টেলিকমিউনিকেশন দফতরের রচনা প্রতিযোগিতা
- ঢাকা পলিটেকনিকে জানুয়ারি-জুন’২০ সেশনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি শুরু
- জেএসসি-পিইসির ফল বছরের শেষ দিন
- ৪০তম বিসিএস: লিখিত পরীক্ষা ৪-৮ জানুয়ারি
- তিতুমীর কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের নিবন্ধন শেষ আজ
Submit Your Comments: